ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাকে শুভেচ্ছা জানানো প্রথম বৈশ্বিক নেতাদের একজন
রঞ্জিত কুমার: ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান হাতি (দলের প্রতীক) ভারতীয় হাতির সঙ্গে সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবে।

এই অংশীদারিত্ব উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থ ও উদ্বেগ সমাধানের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বৈশ্বিক স্তরে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত, যা বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুই দেশের জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিতে অপরিহার্য।

ভারত-মার্কিন স্থায়ী অংশীদারিত্ব
২১ শতকের শুরু থেকেই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে। এই সম্পর্ক দুই দেশের অভ্যন্তরীণ সমর্থন এবং দ্বিপাক্ষিক কল্যাণে নিবেদিত সদিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নতিতে দ্বিপক্ষীয় সমর্থন এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।

ফলে, দুই দেশের সরকার কৌশলগত ও উচ্চ প্রযুক্তি সহযোগিতার বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এই সম্পর্ককে ২১ শতকের একটি “নির্ধারক অংশীদারিত্ব” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য উভয় দেশের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে।

যে কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে—ডেমোক্র্যাট বিল ক্লিনটন, রিপাবলিকান জর্জ বুশ, ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা কিংবা রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে—ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ধারাবাহিক উন্নয়ন লক্ষ করা গেছে।

এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতা, যা ২০০০ এর দশকের শুরুতে শুরু হয়েছিল। এর পরপরই বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পরে বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত খাতে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করে।

মোদি-ট্রাম্প বন্ধুত্ব
কৌশলগত মহল আশা করছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারত-মার্কিন কৌশলগত সম্পর্ক আরও গতিশীল হবে। এটি আংশিকভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে।

২০১৯ সালে হিউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ র‍্যালিতে ট্রাম্পের অংশগ্রহণ এবং ২০২০ সালে আহমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই নেতার ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট হয়েছে।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে কোয়াড সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সফরকে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবেন।

উল্লেখযোগ্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়, হিউস্টনে 'হাউডি মোদি' র‍্যালিতে ট্রাম্পের উপস্থিতি এবং আহমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ ইভেন্টে মোদির আয়োজন দুই নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিদর্শন।

ট্রাম্পের নির্বাচনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন, যার উত্তর ট্রাম্প পরে টেলিফোনে দেন। এই আলাপে ট্রাম্প ভারত এবং মোদির প্রতি তার সম্মান প্রকাশ করেন এবং বলেন, “মোদি এবং ভারতকে আমি প্রকৃত বন্ধু হিসেবে দেখি।”

মোদি-ট্রাম্প বন্ধুত্বের উপর ভিত্তি করে সম্পর্ক উন্নয়ন
ভারত আশা করছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত অর্জনগুলো ব্যবহার করে এবং ইতিবাচক সম্পর্ক ধরে রেখে আগামী দিনে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব আরও গভীর করবে।

কৌশলগত স্বার্থ যেমন চীন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে সহযোগিতা, উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পে ভারতকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা, এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে অংশীদারিত্ব—এই সবকিছু ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তবে বর্তমানে এটি চীনের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে সহযোগিতার মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

ভারত-মার্কিন যৌথ উদ্যোগ 'ইনোভেশন হ্যান্ডশেক' দুই দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে সংযুক্ত করছে। এর ফলে, কৌশলগত ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে (আইসিইটি) সহযোগিতা বাড়ছে।

উপসংহার
এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলোর আলোকে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতিমালা ভারত খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। কারণ, ট্রাম্প স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা সৃষ্টি করা হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রযুক্তি খাতের দক্ষ কর্মীদের গুরুত্ব স্বীকার করেছে, যারা আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই বোঝাপড়া উভয় দেশের জন্যই লাভজনক, যেখানে ভারত তার প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র এর থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে পারে।

ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বিভিন্ন চুক্তি করেছে, যা প্রতিরক্ষা, কৌশলগত উদ্যোগ, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, সেমিকন্ডাক্টর, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ গবেষণা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়িয়েছে।

এই চুক্তিগুলো দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে বহুমুখী স্তরে শক্তিশালী করেছে। গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি উভয় দেশের জন্যই সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছে।

উভয় দেশের জন্য একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, যা অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করেছে এবং উচ্চ পর্যায়ের বোঝাপড়া নিশ্চিত করেছে।

ভারত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অনন্য অংশীদার হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই দুই দেশ বার্ষিক ২+২ সংলাপ পরিচালনা করে, যেখানে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী অংশ নেন।

এর পাশাপাশি, সিকিউরিটি অব সাপ্লাই অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং রিসিপ্রোকাল ডিফেন্স প্রোকিউরমেন্ট অ্যারেঞ্জমেন্ট এর মতো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে, ভারত আশা করতে পারে যে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও গভীর হবে এবং উভয় দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলোর প্রতি আরও সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে।

লেখক: রঞ্জিত কুমার একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবং কৌশলগত বিশ্লেষক। প্রবন্ধে ব্যক্ত মতামত লেখকের নিজস্ব। সূত্র: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক