মিত্র রাষ্ট্রগুলোতে খনিজ সম্পদ অন্বেষণের এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে লাভবান হবে ভারতীয় অর্থনীতি।
অস্ট্রেলিয়া, চিলি এবং আর্জেন্টিনার মতো মিত্র রাষ্ট্রসমূহ থেকে খনিজ সম্পদ অন্বেষণ ও আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এতে চীন থেকে খনিজ আমদানির বিষয়ে যেমন নির্ভরশীলতা কমবে, পাশাপাশি আত্মনির্ভর ভারত গড়তে এই উদ্যোগ কাজে লাগবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

জানা গিয়েছে, লিথিয়ামের ক্ষেত্রে চিনের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে উদ্যোগী ভারত। এবার আর্জেন্টিনার ৫ টি লিথিয়াম ব্লক অধিগ্রহণ করল নয়াদিল্লি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কাবিল সেখান থেকে উত্তোজন করবে এই দাবি ধাতু। এর জন্য ২০০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। বর্তমানে ১০০ শতাংশ লিথিয়াম আমদানি করতে হয় ভারতকে। যার ৯৫ শতাংশেই আসে চীন বা হংকং থেকে।

বলা হচ্ছে, লিওনেল মেসির দেশের অত্যন্ত দামি এই ধাতুটির খোলা মুখ খনির ব্লক অধিগ্রহণ করেছে নয়াদিল্লি। সেখান থেকে লিথিয়াম উত্তোলন ও আমদানি -- এবার থেকে সবটাই নিয়ন্ত্রণ করবে এদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।

সোমবার আর্জেন্টিনার সংস্থা ক্যাটামার্কা মিনেরা ওয়াই এনারজেটিকা সোসিয়েদাদ দেল এস্তাদোর (ক্যামেইন) সঙ্গে লিথিয়ামের ব্লক সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করে এদেশের খনিজ বিদেশ ইন্ডিয়া লিমিটেড বা কাবিল। যার মাধ্যমে মোট ০৫ টি ব্লক হাতে পাচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। কেন্দ্রীয় খনিমন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশীর উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় এই চুক্তি। ওই সময় উপস্থিত ছিলেন আর্জেন্টিনায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ ভাটিয়া।

এই চুক্তি অনুযায়ী, আর্জেন্টিনার কাতামার্কা প্রদেশে ১৫ হাজার ৭০৩ হেক্টর জমিতে লিথিয়ামের অনুসন্ধান চালাবে কাবিল। সেখানে মোট ০৫ টি ব্লক তৈরি করে শুরু হবে অত্যন্ত দামি এই খনিজটির উত্তোজনের কাজ।

আর্জেন্টিনার সঙ্গে লিথিয়ান চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী বলেন, ‘আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলাম। ভবিষ্যতে এনার্জি সেক্টরে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।’ উল্লেখ্য,বিদ্যুতিন ব্য়াটারি তৈরির অন্যতম উপাদান হল লিথিয়াম। এই ধাতুটি ছাড়া মোবাইল ফোন, ল্য়াপটপ এমনটি গাড়ির ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে ১০০ শতাংশ লিথিয়ামই আমদানি করে ভারত। বাণিজ্য মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি কিনতে ২.৮ বিলিয়ান মার্কিন ডলার খরচ করেছিল নয়াদিল্লি। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, গত বছর জম্মু-কাশ্মীরে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম ভাণ্ডারের কথা প্রকাশ করে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। সেখান থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই খনিজটির উত্তোলনের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যেই আর্জেন্টিনার সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কাবিল।

প্রসঙ্গত, চিলি ও বলিভিয়ার পর মেসির দেশেরই সবচেয়ে বেশি লিথিয়াম মজুত রয়েছে। শুধু তাই নয়, আর্জেন্টিনায় আছে লিথিয়ামের উন্মুক্ত খনি। ফলে সেখানে এই ধাতু উত্তোলনের খরচ খুব বেশি হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, আর্জেন্টিনা থেকে লিথিয়াম আমদানি শুরু হলে মারাত্মকভাবে মার খাবে চীনের একচেটিয়া ব্যবসা।

এদিকে, চিলি ও অস্ট্রেলিয়ার সাথেও খনিজ অন্বেষণ চুক্তি করছে ভারত। এছাড়া, আরও জানা গিয়েছে, দেশে বসেই খনিজ উৎপাদন এবং পরিশোধন করবে সরকার। তামা এবং লিথিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলি উৎপাদন করে, তাদের পুনর্ব্যবহারের পাশাপাশি এই জাতীয় সম্পদের জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও অধিগ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্দেশ্যেই একটি মিশন চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে মঙ্গলবার। মিশনটির নাম ক্রিটিকাল মিনারেল মিশন। ২০২৪-২৫ সালের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এও বলেছেন যে সরকার অফশোর মাইনিং ব্লকের প্রথম দফা নিলামও শুরু করবে শীঘ্রই।

এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এদিন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমরা খনিজগুলোর ঘরোয়া উৎপাদন, খনিজগুলির পুনর্ব্যবহার করার জন্য একটি ক্রিটিকাল খনিজ মিশন শুরু করব। প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষ কর্মীবাহিনী, উপযুক্ত অর্থায়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই মিশন এগিয়ে থাকবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, সরকার খনির জন্য অফশোর ব্লকের প্রথম অংশের নিলাম শুরু করবে, অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হবে। গভীর সমুদ্রতল থেকে ২০০ মিটারেরও বেশি গভীরতায় খনিজ আমানত পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় অফশোর মাইনিং।

তামা, লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, পৃথিবীর বিরল এই উপাদানগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ খনিজ। এগুলি দ্রুত বর্ধনশীল। বায়ু টারবাইন এবং বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক থেকে বৈদ্যুতিক যান পর্যন্ত শক্তি প্রযুক্তিগুলির জন্য অপরিহার্য উপাদান এগুলি। যত এই ধরনের এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে, খনিজগুলোর চাহিদাও লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।

ভারত হল গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির একটি নিট আমদানিকারক। কিন্তু এবার গার্হস্থ্য খনিজ উৎপাদনেও এগিয়ে থাকার জন্য, খনি মন্ত্রক গত বছর খনি ও খনিজ সংশোধনী বিল ২০২৩ পাস করেছিল, যার মাধ্যমে এটি খনিজগুলির জন্য অনুসন্ধান লাইসেন্স প্রদান করতে পারে। উল্লেখ্য, গত বছর, সরকার ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। এতে রয়েছে অ্যান্টিমনি, বেরিলিয়াম, বিসমাথ, ক্যাডমিয়াম, কোবাল্ট, তামা, গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম, গ্রাফাইট, হাফনিয়াম, ইন্ডিয়াম, লিথিয়াম, মলিবডেনাম, নাইওবিয়াম, নিকেল, পিজিই, ফসফরাস, পটাশ, আরইই (বিরল পৃথিবীর উপাদান), ট্যানটালাম ইত্যাদি। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক